ব্যবসায় উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট্য
ব্যবসায় সাফল্য শুধু মূলধন ও অন্যান্য উপকরণের উপর নির্ভর করে না । সাফল্যের জন্য প্রয়োজন একজন সফল উদ্যোক্তা । কেননা একজন ব্যবসায় উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক যোগ্যতার উপর ব্যবসায়ের সাফল্য অথবা ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে। তাই একজন সফল ব্যবসায় উদ্যোক্তা হতে হলে তাকে কতকগুলো ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত। তাই অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীগণ ব্যবসায় উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপে নিরূপণ করতে চেষ্টা করেছেন।
১। মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সাফল্য লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনতা, স্বীকৃতি, ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা, মনোভাব, সৃজনশীল, উদ্ভাবনী শক্তি, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস, প্রতিশ্রুতি, অধ্যবসায়, বুদ্ধিমত্তা, দূরদৃষ্টি, জানার ইচ্ছা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
২। অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য : উদ্যোক্তার অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পেশাগত অভিজ্ঞতা, মূলধনের জোগান ও ব্যবহার ক্ষমতা, প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞতা, সুযোগ-সুবিধার ব্যবহার, অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান ইত্যাদি অন্যতম ।
৩। সামাজিক বৈশিষ্ট্য: উদ্যোক্তার সামাজিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতা পৈতৃক গুণাবলির প্রতিফলন, সামাজিক কার্যকলাপে উদ্যোগ গ্রহণ, বংশমর্যাদা ও পারিবারিক মর্যাদা অন্যতম ।
৪। সাধারণ বা ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য : উদ্যোক্তার সাধারণ বা ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শিক্ষা, বয়স, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, বিক্রয় করার গুণাবলি, কৌশল, সততা, অর্থের প্রতি আগ্রহ, ত্যাগী মনোভাব, পরিশ্রমী, আন্তরিকতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
ব্যবসায় উদ্যোক্তার শ্রেণিবিন্যাস
উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিচার করলে শিল্পোদ্যোক্তাকে নিম্নবর্ণিত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ।
নিম্নে বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায় উদ্যোক্তার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো
১। কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন উদ্যোক্তা: এ ধরনের উদ্যোক্তাগণ যথেষ্ট কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন হয়ে থাকেন । এ ধরনের শিল্পোদ্যোক্তাগণ করিৎকর্মা ও বাস্তবমুখী। এ ধরনের উদ্যোক্তাগণ ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বেশি আগ্রহী । ব্যক্তিগত যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে এরা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নিয়োগ করেন ।
২। সুযোগসন্ধানী উদ্যোক্তা: যে সকল শিল্পোদ্যোক্তা বাজারে বিদ্যমান সুযোগকে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের সফলতা আনয়নে চেষ্টা করেন, তাদেরকে সুযোগ সন্ধানী শিল্পোদ্যোক্তা বলে। এ ধরনের শিল্পোদ্যোক্তাগণ বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে কাজ করে থাকেন। তারা বিদ্যমান ও নতুন পরিস্থিতিতে সুযোগ গ্রহণে প্রস্তুত থাকেন। এ ধরনের শিল্পোদ্যোক্তা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যথেষ্ট শিক্ষিত হয়ে থাকেন। তারা নিজেদের কারিগরের চেয়ে একজন ব্যবস্থাপক হিসেবে গণ্য করতে আগ্রহী। এ ধরনের শিল্পোদ্যোক্তাগণ অধিক জনসংযোগে বিশ্বাসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকেন।
৩। উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্যোক্তা (Innovative entrepreneur): এ ধরনের উদ্যোক্তাগণ যথেষ্ট উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন। ব্যবসায়ের নিত্যনতুন ক্ষেত্র ও কলাকৌশল উদ্ভাবন, নতুন পণ্য আবিষ্কার ও বাজার সৃষ্টি, নতুন কৌশল উদ্ভাবন ইত্যাদি এ ধরনের শিল্পোদ্যোক্তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তারা নিজের উদ্যোগে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করেন, উৎপাদনের উপকরণগুলোকে একত্রিত করে পণ্য উৎপাদন করেন এবং প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখার চেষ্টা করেন। এ ধরনে শিল্পোদ্যোক্তারা উদ্ভাবন কার্য পরিচালনায় এবং উদ্ভাবনী কার্যসমূহকে শিল্পসম্মতভাবে ব্যবহারে আগ্রহী।
৪। অনুকরণপ্রিয় উদ্যোক্তা (Imitative entrepreneur): এ ধরনের শিল্পোদ্যোক্তাগণ নিজের সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে অন্যের মাধ্যমে উদ্ভাবিত, আবিষ্কৃত এবং প্রয়োগকৃত প্রযুক্তি ও কলা-কৌশল অনুকরণ করতে আগ্রহী । এদের প্রধান লক্ষ্য অন্যের উদ্ভাবনমূলক কাজকে অনুকরণ করে উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি সাধন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখা । অনুন্নত দেশসমূহে সাধারণত এ ধরনের শিল্পোদ্যোক্তা পরিলক্ষিত হয় । তারা উন্নত দেশের উৎপাদন কৌশল নিজের দেশে প্রয়োগ করে সফলতা আনার প্রয়াস চালান ।
৫। উদ্যমী, সাহসী ও পরিশ্রমী উদ্যোক্তা: (Dynamic, Brave and labourious) এ ধরনের উদ্যোক্তাদের প্রচণ্ড সাহস ও উদ্যম থাকে। এ ধরনের উদ্যোক্তাকে নানাবিধ ঝুঁকি ও সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় । তাই উদ্যম সাহস নিয়ে উক্ত ঝুঁকি সামলাতে তাদেরকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। এরা উদ্যমী, সাহসী ও পরিশ্রমী হয় বলেই পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হন । তারা নিজেরা যেমন উদ্যমী, সাহসী ও পরিশ্রমী, অন্যদেরকেও অনুরূপ হতে উৎসাহী করেন ।
মালিকানাভিত্তিক শিল্পোদ্যোক্তা
(ক) সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ: মালিকানা ভেদে শিল্পোদ্যোগকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবে ভাগ করা যায়। শিল্পোদ্যোগ সাধারণত একটি বেসরকারি কার্যকলাপ হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ ও প্রসার লাভ করছে। যেসব দেশে বৈদেশিক মূলধনের অভাব এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিল্পোদ্যোক্তার স্বল্পতা রয়েছে সেসব দেশে । অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাসহ শিল্পায়নে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে সেক্টর কর্পোরেশন এবং আরো কিছুসংখ্যক সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি শিল্প স্থাপন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।
(খ) একক এবং ব্যাপকভিত্তিক শিল্পোদ্যোগ: শিল্পোদ্যোগকে আবার একক এবং ব্যাপকভিত্তিক শিল্পোদ্যোগ হিসেবে বিভক্ত করা যায়। পাকিস্তান আমলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে দেশে পরিবারভিত্তিক শিল্পোদ্যোগ সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারের সামগ্রিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা পরিবারভিত্তিক একদল বাণিজ্য বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকে একক শিল্পোদ্যোগ বলা হয় । এভাবে সরকারি নীতির মাধ্যমে ভাগ্যবান শিল্পসমৃদ্ধ পরিবার সৃষ্টির ফলে একটি অনগ্রসর অর্থনীতিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় ।
যেসব দেশে উন্নয়নের ব্যাপক অংশজুড়ে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি জড়িত, সেখানে ব্যাপকভিত্তিক শিল্পোদ্যোগ সৃষ্টির প্রয়োজন সর্বাধিক। এ ধরনের ব্যাপকভিত্তিক শিল্পোদ্যোগ কৌশল দেশের বিদ্যমান সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে বেকার ও অর্ধবেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। বাংলাদেশের প্রকট বেকার সমস্যার প্রেক্ষাপটে ব্যাপকভিত্তিক শিল্পোদ্যোগ আবশ্যক ।
আরও দেখুন...